জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার
[পঁয়তাল্লিশ]
পঞ্চায়েত প্রধান সনাতনের বাড়ি আসার অধিকার এখন এই অঞ্চলের সকলের। যে কেউ প্রয়োজনে তার কাছে আসতে পারে। আসেও। তাতে কারোর মনে প্রশ্ন থাকার কথা না যে, সেই ব্যক্তি কেন, কি উদ্দেশ্যে সনাতনদের বাড়ি এসেছে। সেই কথা মাথায় রেখে সেদিন ভোর-ভোর বিপ্লবের মা সীতাদেবী এসে হাজির সনাতনদের বাড়ি। ভোরে আসার কারণ, যাতে সনাতনকে একা পাওয়া যায়। সনাতন তখন বাথরুম সেরে দাঁতে ব্রাশ করছে। এত ভোরে বিপ্লবদার মাকে দেখে চমক খায় সনাতন। তাড়াতাড়ি করে মুখ ধুয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,“কি খবর কাকিমা? হঠাৎ এত সকালে? বিপ্লবদার কোন খবর আছে?” ততক্ষণে সীতাদেবীর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ছে। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, “তার খবর নিতেই তো তোমার কাছে এলাম বাবা। কতদিন হয়ে গেল ছেলেটা বাড়ি ছাড়া। বাপ তাড়িয়ে দিয়েছে। অভিমানে ছেলে সেই যে বাড়ির সদরের বাইরে পা রাখল আর এ’মুখো হল না। আমি মা হয়ে কেমন করে তা মেনে নিই বল বাবা? রাতে ঘুম আসে না। স্বপ্নে দেখি ছেলেটাকে আর চমকে উঠি। বাপের মন ভাঙে তো বচন নড়ে না। বেজাতের মেয়েকে সে ঘরে তুলবে না। আর তোমার বিপ্লবদাকে তো তুমি চেনো। সেও তার কথা থেকে সরবে না। বাপ বেটার এই জেদাজেদির মধ্যে পড়ে আমার তো প্রাণ উবে যায়-যায়। এমনিতে কারবারে মন্দা যাচ্ছে। আর ছেলেটা বাড়ি ছাড়ার পর কাজকর্ম সব লাটে উঠেছে। তোমার কাছে ওর কোন খবর নেই, না বাবা?”
-না কাকিমা। আমরাও তো সেই কথাই ভাবছি। বিপ্লবদা ইকনমিক্স নিয়ে এম.এস.সি. পড়ার তোড়জোড় করছিল। আমরা আনন্দ করে বললাম, তুমি এগিয়ে যাও দাদা। তোমাকে দেখে যদি আমরা প্রেরণা পাই। সেসব বন্ধ করে কোথায় গেল কে জানে! তবে আমি হাল ছাড়িনি। খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছি। হদিশ পেলেই আপনাকে খবর পাঠাব। সনাতন অন্তর থেকে বলল।
আশেপাশে কেউ আছে কিনা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সীতাদেবী আস্তে করে সনাতনকে বলল, “হ্যাঁরে বাবা, ওই অলোকা মেয়েটার বাড়ির লোক ওর বিয়ের জন্যে দেখাশোনা করছে না?”
সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে বিরক্তভাবে সনাতন বলল,“কেন বলো তো কাকিমা? সেরকম কিছু তুমি শুনেছো নাকি? বা তোমার হাতে অলোকাদির উপযুক্ত ছেলে আছে নাকি? তাছাড়া অলোকাদির বিয়েথার ব্যাপারটা অলোকাদির হাতেই ছেড়ে দিয়েছে ওদের বাড়ির বড়োরা। অলোকাদির মত বিদ্বান, সুন্দরী, শিক্ষিকার পাত্র দেখার যোগ্যতা ওর বাবা-মায়ের নেই। সেই কথা বলেও দিয়েছে তার বাবা-মা। আর আমি যতটুকু জানি, মানে অলোকাদি এবং বিপ্লবদার মুখ থেকে যতটা জেনেছি, ওরা দু’জনে দু’জনকে প্রচন্ড ভালবাসে। বিয়ে করলে ওরাই হবে ওদের পছন্দের পাত্রপাত্রী। এই জুটি বিপ্লবদার বাবার মতো তোমারও পছন্দ নয়, তাই না কাকিমা? আমার তো মনে হয়, মা হয়ে তোমাকে এটা মেনে নেওয়া উচিত। জাতপাত ছাড়ো না। ওটাকে তো চোখে দেখা যায় না। বিশ্বাসের ব্যাপার। তা, জন্মসূত্রে পাওয়া সেই বিশ্বাস যে যার নিজের মধ্যে থাকুক না। কিন্তু যেটা দৃশ্যত সত্যি সেটা হল বিপ্লবদা তোমাদের একমাত্র সন্তান। জাতের নিজস্ব কোনো চেহারা নেই। কিন্তু এই জাতের দোহাই দিয়ে নিজেদের মুর্খামি অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে না তো কাকিমা! বিপ্লবদা উচ্চশিক্ষিত একটা ছেলে। তার শিক্ষাদীক্ষার ধারে কাছে তোমরা কেন তোমাদের পাড়ার কেউ আজ পর্যন্ত যেতে পারেনি। তার জ্ঞানগম্মির সঙ্গে তোমাদের ওদিকের কারোর তুলনা চলে না। তাহলে কোন যোগ্যতায় তোমরা তার উপর অধিকার ফলাতে যাও জানি না। শুধু পিতামাতার অধিকারে এতবড় ভুল সিদ্ধান্ত তোমরা নিয়ে নিলে কাকিমা? তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলে? এটা কেমন কাজ হল তোমাদের কাকিমা! কাকিমা, আমি জানি আমার শক্ত শক্ত কথাগুলো তোমার ভালো লাগছে না। তাই উশখুশ করছো কতক্ষণে তুমি এখান থেকে চলে যাবে। যাবে তো বটেই। তবে একবার ভেবে দেখো কাকিমা, আমি কি বলতে চাইলাম।”
সনাতনের মাস্টারির হাতযশে এবার মাধ্যমিকে অন্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে খুব ভাল ফল করে সুন্দরীও। ওদের বাড়ি তো দারুণ খুশি। আনন্দে আপ্লুত হয়ে সুন্দরীর মা মিষ্টিমুখ করাতে সনাতনদের বাড়ি এসেছে। সুন্দরীও মায়ের আঁচল ধরে এসে হাজির। ওকে দেখে সনাতনের মা বলল,“তোর মাকে একটু চা করে খাওয়া তো মা? আমাদের জন্যেও বেশি করে জল বসিয়ে দিস। তোর স্যার ঘাটে গেছে। এক্ষুণি এসে যাবে।” সুন্দরী চা করতে গেলে সনাতনের মা বলে, “তোমার মেয়েটা বড়ই মিষ্টি স্বভাবের দিদি। কোনো কথায় ‘রা’ কাটে না। যা কাজ বলবো মুখ বুজে সঙ্গে সঙ্গে হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দেবে সেটা করার জন্যে। ওটাকে আমার ঘরে রেখে দেব। বলে রাখছি তোমায় দিদি।”
সনাতনের মায়ের কথায় সুন্দরীর মা বলে,“ছেলের মন আবার কি বলে তা তো জানা দরকার। তোমার শিক্ষিত ছেলে। সেইসঙ্গে আমাদের পঞ্চায়েতের প্রধান। কত দামি ছেলে তোমার। তার কাছে আমার সুন্দরী তো কত সাধারণ। পরে যদি সে বেঁকে বসে তো আমরা বিপদে পড়ে যাব। তাই না দিদি।”
-তুমি অত বোকা কেন দিদি? এটুকুও বোঝো না। আজকাল কত ভালমন্দ, নামী-অনামী লোক প্রধানের বাড়িতে আসে। লোকজন একটু বেশি হলেই ছেলে আমাকে বলবে, সুন্দরীকে ডেকে আনো মা। তুমি একা এত কাজ সামলাতে পারবে না। পছন্দ না করলে কথায় কথায় সুন্দরীকে ডাক দেয় কেন ছেলে সেটা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। মা হয়ে আমি ছেলের মন খুব ভাল করে বুঝতে পারি।” বলতে বলতে সনাতন ঘাট থেকে এসে দেখে সুন্দরী রান্নাঘর থেকে চা নিয়ে আসছে। ওকে দেখে সনাতন বলল,“সুন্দরী এসেছিস, ভাল হয়েছে। দাবায় মাদুরটা বিছিয়ে ঘরের টেবিল থেকে লাল ফাইলটা আর পেনটা এনে দে।” আগের কথার রেশ ধরে সনাতনের মা বলল, “দেখলে তো সুন্দরীর মা, ছেলে কতটা তোমার মেয়েকে ভরসা করে। আমাদের বাড়ির কোথায় কি আছে সব তোমার মেয়ের মুখস্থ। আমি মুখ্যু মানুষ। কাগজপত্রর কিছু বুঝি নাকি! তাই সুন্দরীকে পেলে ছেলে আমার খুব খুশি। দেখছো তো নিজের চোখে। এর পর কি বলবে, ছেলের অপছন্দ তোমার মেয়েকে? ওসব ভাবনা ছাড়ো। সুন্দরীকে আমার জন্যেই রেখে দাও। পারলে এখন থেকেই থাকুক আমার কাছে। আমার তাহলে আর মেয়েকে ডাকতে তোমার বাড়ি বারবার ছুটতে হয় না। সময় মত চার হাত এক করে দেবো’খন। খুশির দমকে হাসতে হাসতে বলল সনাতনের মা।
সকাল থেকে শুরু হয়ে গেছে আটচালার ভেতরটা সাজগোছ করা। তিনজন বসার মত ছোট্ট একটা স্টেজও করা হয়েছে তার মধ্যে। সাজানো হচ্ছে কাগজের রংবেরঙের ফুল দিয়ে। সনাতন আর অখিল দু’জনে মিলে সবকিছুর তদারকি করছে। পাড়ার সব বাড়ি বাড়ি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আজ আমাদের পাড়ার মুখ উজ্জ্বল করা মেয়ে, অলোকাকে সম্মানিত করা হবে। বাইরের কিছু
গুনী মানুষ আসবেন এই উপলক্ষ্যে। অনুষ্ঠানকে সফল করার জন্যে সকলের উপস্থিত থাকা প্রয়োজন। আগে থেকে অলোকাদির সঙ্গে কথা বলে আজকের দিনটাই স্থির হয়েছে। ব্যাপারটা নিয়ে গোটা রুইদাসপাড়ায় একটা খুশি খুশি ভাব। বিশেষ করে উঠতি ছেলেমেয়েরা, যারা লেখাপড়ার সঙ্গে যুক্ত। তাদের মনে তো খুশির অন্ত নেই। পাশাপাশি আবার প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মত আর একটা দল সনাতন-অলোকাদের কাজের বিরোধিতার অস্ত্রে শান দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাড়ি বাড়ি অনুষ্ঠানের কথা জানানোর সময় ওই দলের অন্যতম স্যাঙাৎ বরেণ অনুষ্ঠানে তাদের ভূমিকার কথা সনাতন-অখিলকে জানিয়ে দিতে বলে, “তোমরা যাকে নিয়ে মাতামাতি করছো, সেই অলোকা রুইদাসের বিরুদ্ধে আমাদের গুরুতর অভিযোগ আছে। সেই অভিযোগ জানানোর সুযোগ না দিলে আমরা কিন্তু বাইরের অতিথিদের সামনে গণ্ডগোল শুরু করে দেব। তখন তোমরা আমাদের দোষ দিতে পারবে না। আগে থেকে সেকথা জানিয়ে দিচ্ছি আমরা।” সেইসময় জড়ো হয়ে গেল ওই দলের নোচে, বিন্দে, কেলে, অভয়রাও। তারাও বরেণের কথাতে সায় দিয়ে হম্বিতম্বি করতে শুরু করে। সনাতন দেখল এদের এই মুহূর্তে থামাতে না পারলে এরা আরও মাথায় চড়ে বসবে। কড়া গলায় সনাতন বলল, “অলোকাদির সম্মান অনুষ্ঠানে কাউকে কিচ্ছু বলার অনুমতি দেওয়া হবে না। বাইরের গণ্যমান্য মানুষের সামনে কেউ যদি হুল্লোড় পাকাবার কথা ভাবে, তাহলে তারা ভুল করবে। তাদের মনে রাখা উচিৎ আয়োজকদেরও লোকজন আছে। তাদের ক্ষমতাকে খাটো করে দেখলে পরিণতি ভাল হবে না বলে দিলাম। তখন হুল্লোড়বাজরা কত ধানে কত চাল বুঝতে পারবে। মূল অনুষ্ঠান শেষ হবার পর অতিথিজনেরা চলে গেলে আটচালার সভা বসানো যেতে পারে। তখন তোরা তোদের কথা বলার সুযোগ পাবি। পাড়ার সব্বাইকে তখন থাকতে বলা হবে।” সনাতন বলার পর রাগে গরগর করতে করতে অখিল বলল, “ভাই সনাতন, তুই শুধু আমাকে মুখ ফুটে বলবি, কি করতে হবে। তারপর আমি গোটা ব্যাপারটা বুঝে নেব। এদের দৌড় কতটা তা আমার খুব ভাল করে জানা আছে। কেষ্টার চুল্লুর ঠেক পর্যন্ত তো এদের দৌড়। সে আমি দেখে নেবখন।
বরেণ-অভয়রা বুঝতে পারেনি সনাতন-অখিলরা এইভাবে তাদের ধমক দিতে পারে। ওরা থতমত খেয়ে যায় অখিলদের পাল্টা প্রতিক্রিয়ায়। থমকে গিয়ে অভয় বলে, “ঠিক আছে, পরে যখন আটচালা বসবে তখন আমাদের কিছু বলার নেই। বাইরের লোকের সামনে আমরা কিছু করতে যাব না। তাতে আমাদের পাড়াকে লোকে ভুল বুঝবে। সেইসঙ্গে আমাদেরকেও ওরা খারাপ চোখে দেখবে। পাড়ার বদনাম আমরা করতে চাই না।”
কয়েকটা গ্রামের বিশিষ্ট অতিথিদের উপস্থিতিতে অমর স্যার অলোকার হাতে ফুলের তোড়ার সাথে সাথে একটা সুন্দর সাদা পাথরের সরস্বতীর মূর্তি দিয়ে সম্মান জানালেন। অমর স্যার তাঁর বক্তৃতায় বললেন,“আমাদের সমাজের প্রান্তস্তর থেকে অলোকার মত মেয়ে তার নিজের যোগ্যতায় এই জায়গায় উঠে আসা সত্যিই নজিরবিহীন এক ঘটনা। অলোকার এই সাফল্য সমাজের পিছিয়েপড়া এবং পড়াশোনায় বীতস্পৃহ ছেলেমেয়েদের প্রেরণা দেবে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে। আমার ছাত্রী হিসেবে নিজে গর্ব বোধ করছি। আপনাদেরও গর্ব আপনাদের ঘরের মেয়ে দেখিয়ে দিল কোন বাধাই এগিয়ে যাবার পথে অন্তরায় হতে পারে না যদি নিজের মধ্যে জেদ, সাহস এবং লক্ষ্য স্থির রেখে চলতে পারা যায়। বিশেষ করে অলোকাদের মত মেয়েরা। সবশেষে আমি অলোকাকে আশীর্বাদ করছি জীবনপথে ও আরও এগিয়ে যাক। শুভেচ্ছা জানাচ্ছি আপনাদের- ঘরের কোণে এই মেয়েটাকে আটকে না রেখে পড়ার সুযোগ করিয়ে দেবার জন্যে।” অমর স্যারের সংক্ষিপ্ত ভাষণ শেষ হতেই সভায় হাততালির ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল। এত মানুষ তার সাফল্যকে স্বাগত জানাচ্ছে দেখে অলোকা আপ্লুত হয়ে গেল। এক ভালোলাগার অভিঘাতে তার পা যেন থরথর করে কাঁপতে লাগল। সেইসঙ্গে চেষ্টা করতে লাগল নিজেকে সামলে নেবার জন্যে।
এবার সঞ্চালক, সনাতন রুইদাস আজকের এই মহতী অনুষ্ঠানের মধ্যমণি, তাদের ঘরের সন্তান অলোকা রুইদাসকে নিজের অনুভূতির কথা বলার জন্যে অনুরোধ করলো। কিন্তু অলোকা এত মানুষের সামনে কিছু বলতে চাইছিল না। আসলে বলার অভ্যেস না থাকার জন্যে, কি বলবে বুঝতে না পারার কারণে এমন অনিহা জন্মায়। মনে মনে বলার চেষ্টা করে কিন্তু কথা যেন সব হারিয়ে যায়। কি কথা বলবে, গলায় এসে দলা পাকিয়ে সব আটকে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে তার। তবু সকলের অনুরোধে বিশেষ করে তার অমর স্যারের অনুরোধে অলোকা বলতে উঠে শুধু এইটুকু বলতে পারল,“আমার এই সাফল্য আমি আমাদের রুইদাস সমাজকে উৎসর্গ করলাম। সেইসঙ্গে একটাই আমার চাওয়া- আমাদের সমাজ যেন আধুনিক ধ্যানধারণার প্রতি সম্মান জ্ঞাপন করার ভাবনাকে সমর্থন জানায়। মেয়েদেরকে স্বাধীনভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য ও সহযোগিতা করে। তাহলে পিছিয়ে পড়ে থাকা এই সমাজ আর-সকল সমাজের সঙ্গে সমকক্ষ হতে দেরি হবে না। প্রতিভা তাদের জাতের মেয়েদের অন্যদের থেকে কম নয়। সেই প্রতিভাকে উন্মোচন করতে গেলে চাই সমাজ-ধারকদের মুক্ত ভাবনাচিন্তা। তাদের সমাজে যার ঘাটতি লক্ষ্যণীয়ভাবে প্রকট। সবশেষে বলি, ব্যক্তির ভাল হলে সমাজেরও ভাল হবে। ব্যক্তি-সমাজ একে অপরের পরিপুরক। কাউকে বাদ দিয়ে কেউ সম্পূর্ণ নয়।” অলোকাদির বলার শেষে অমর স্যারের মত হাততালির ঝড় উঠল না। বোঝা গেল অলোকার বক্তব্যে রুইদাস সমাজের দিক থেকে স্বতস্ফুর্ত হাততালি এল না। আসার কথা তো অলোকাদি বলেনি। ও যে তাদের সমাজকে সবক শেখার পরামর্শ দিয়েছে। তাই গোঁড়া আর নিন্দুকদের পছন্দ হবার কথা নয় যে। এরা এখনো তাদের জাতিগত সংস্কারকে শিখন্ডী রেখে সেই মধ্যযুগীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন পদক্ষেপকে জিইয়ে রাখতে চায়। সমাজের উপর নিজেদের প্রতিপত্তিকে টিকিয়ে রাখতে চায়। সেটা সনাতন-অখিলরা খুব ভাল করে বোঝে। ওদের এটাও বুঝতে অসুবিধা হল না যে এর পরবর্তী পর্যায়ে আটচালার যে মিটিংটার দাবি করেছে বরেণ-অভয়রা সেখানে এই বক্তৃতার বিরুদ্ধ প্রভাব আছড়ে পড়তে বাধ্য। মনে হল শুধু বরেণ-অভয়দের দল নয়, অন্যরাও, বিশেষ করে আটচালার কমিটির ওই স্বঘোষিত সমাজ ধারক-বাহকরাও এই বক্তৃতাকে ভাল মনে নিতে পারেনি।
অলোকা রুইদাসের বক্তব্য শেষ হবার সাথে সাথে এই সারস্বত সভার সমাপ্তি ঘোষণা করে সনাতন। সম্মানীয় অতিথি এবং বিভিন্ন গ্রাম ও বাইরের পাড়ার বিশিষ্ট অতিথিরা ধীরে ধীরে সভা ত্যাগ করা শুরু করে। সেই অবসরে সনাতন তার বাবা, আটচালা কমিটির অন্যতম বিশিষ্ট সদস্য রতনকে বাড়ি চলে যেতে বলে, “বাবা, এবার তুমি বাড়ি চলে যাও। এখন আটচালার যে মিটিংটা হবে তা অত্যন্ত উত্তেজনা প্রবণ হয়ে উঠবে বলে আমার ধারণা। ডাক্তারবাবু তোমাকে কোনোরকম উত্তেজনা বা গণ্ডোগোলের মধ্যে থাকতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। হার্টের রোগির পক্ষে এটা মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই তুমি বাড়ি যাও। পাড়ার একটা দল এই মিটিংয়ে গণ্ডোগোল পাকাবার জন্যে অনেক আগে থেকে সলতে পাকাচ্ছে। সে খবর আমাদের কানে এসেছে।” ছেলের কথায় রতন আর ‘রা’ না কেটে নিজের আসন ছেড়ে উঠতেই নন্দ, দিবাকর, সুবোধকাকা সহ অন্যান্য বয়স্ক সদস্যরা হইহই করে ওঠে ! সুবোধকাকা বলে,“তুমি বাড়ি চলে যাচ্ছ নাকি, রতন? আটচালার এই গুরুত্বপূর্ণ মিটিংটায় তুমি থাকবে না?” সঙ্গে সঙ্গে রতন কিছু বলতে যাবার আগেই সনাতন বলল, “বাবার ওষুধ খাবার সময় বয়ে যাচ্ছে। হার্টের রোগির ঠিক ঠিক সময় ওষুধ খাওয়া জরুরী। সেইজন্যে আমি বাবাকে বাড়ি চলে যেতে বলেছি। তাছাড়া বাবা যায় যাক-না। তোমরা, মুরুব্বি মানুষরা তো আছো। আমরাও আছি। বাবা না থাকলে কোন অসুবিধা হবে না। বাবা ছাড়া সভা খুব ভালভাবেই চলবে।”
রতন চলে যেতে তার জুটি নন্দকাকা যেন মনমরা হয়ে চুপচাপ হয়ে গেল। সনাতন তা দেখে বলল,“নন্দকাকা, বাবা চলে গেছে তা কি হয়েছে। তোমরা তো আছো। কারোর জন্যে কারোর দিন থেমে থাকে না। সভা শুরু করে দাও।” বলতেই সুবোধকাকা বলল,“আজকের এই জরুরী সভা কে বা কারা তলব করেছো? তারা এখন বলুক, তাদের আর্জিটা কি ?”
সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের মধ্যে থেকে অভয় রুইদাস উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “একটু আগে যাকে নিয়ে হইচই হল। যার নামে গুনগান গেয়ে আকাশ বাতাস মাতিয়ে তোলা হল, সেই গুণময়ী মহিলা, অলোকা রুইদাসের কেচ্ছা কেলেঙ্কারী আজ সকলের সামনে আমি আবেদনকারী দলের পক্ষ থেকে তুলে ধরতে চাই। রুইদাস পাড়ার যে মেয়ে লেখাপড়ার ছুঁতো করে, পড়া জানার নাম করে ভিন জাতের ভিন পাড়ার ছেলের সঙ্গে বেলেল্লাপনা করে বেড়ায়, রুইদাস হয়ে আমরা তা মেনে নিতে পারি না। এই আটচালা বহু আগে থেকে এই কাজ না করার কঠোর বিধান দিয়ে রেখেছে। তা সত্ত্বেও এই অসতী, চরিত্রহীন মেয়ে আটচালার বিধানকে তোয়াক্কা না করে সমানে লেখাপড়ার অজুহাত সামনে রেখে বেজাতের ফালতু একটা ছেলের সঙ্গে দিনদুপুরে নারীসম্মান মাটির মধ্যে লুটিয়ে দিয়ে চারদিকে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। এর আগেও একবার আমরা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে চেঁচামেচি করেছিলাম। কিন্তু পাল পাড়া আমাদের কথা তখন বিশ্বাস না করে আমাদের উপর চাপ সৃষ্টি করে সেদিনের সেই অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের কাছে খবর আছে, সেই পালপাড়া আজ আমাদের অভিযোগ মানতে বাধ্য হয়েছে। তারাও এই অসবর্ণ মেলামেশাকে মেনে নেয়নি। তাই বিপ্লব পাল এখন পাড়া ছাড়া। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল, তাকে আর পাড়ায় দেখা যাচ্ছে না। লোকে বলে তাকে পাড়া থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও একটা আশ্চর্য ঘটনা, মেয়ের এই জঘন্য কাজে তার পরিবার পুরোপুরি মদত দিয়ে গেছে। মেয়ের সঙ্গে তার পরিবারও সমদোষে দোষী। আমরাও চাই, অলোকা রুইদাস ও তার পরিবার এই অন্যায় কাজ করার জন্যে সকলের কাছে ক্ষমা চাক এবং দস্তখত দিক, কোন অবস্থাতেই সে পালপাড়ার ছেলেটার সঙ্গে মেলামেশা করবে না। তাকে বিয়ে করতে হবে পাড়ারই কোন যুবককে। তবেই তাদের সমাজ জাতভ্রষ্ট হবার হাত থেকে রক্ষা পাবে। আর যদি শর্ত না মানে তবে ইতিপূর্বে আটচালার বিধানে সমান অপরাধ করার জন্যে যেমন অপরাধী পরিবারকে পাড়াছাড়া করা হয়েছে, এই পরিবারকেও তাই করা হোক। আটচালার কাছে এটাই আমাদের আবেদন। আশাকরি আমরা সঠিক বিচার পাব।”
যে স্থান কয়েক মিনিট আগে তাকে সম্মানের এতটা উচ্চ শিখরে তুলে দিল সেই আটচালাই তার চরিত্র নিয়ে এমন নোংরা কাদা ছোড়াছুড়ি করতে পারছে! সে কার সঙ্গে কথা বলবে, কার সাথে মেলামেশা করবে, তা ঠিক করে দেবে পাড়ার এই গুটিকয় অশিক্ষিত মাতাল লম্পট ছেলেরা! সেটা আবার তারিয়ে তারিয়ে শুনছে পাড়ার গণ্যমান্য মুরুব্বি মানুষরা! ওই মাতাল অভয় রুইদাসকে এতগুলো কথা বলতে দিল এইসব গণ্যমান্যরা! এ কেমন সমাজে সে বাস করছে! এদের সমাজে তাহলে শিক্ষাদীক্ষা, আধুনিক প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনার কোন জায়গা নেই? শুধুমুধু জাতভ্রষ্ঠের দোহাই দিয়ে একটা সেকেলে চিন্তাকে এইভাবে চাপিয়ে দিতে তারা পারে? এমন অপমান গায়ে মেখে বেঁচে থাকার থেকে তো তার মরে যাওয়াই ভালো। মৃত্যুই তার মুক্তির একমাত্র পথ। নাহলে তার জন্যে তার পরিবারকে শাস্তি পেতে হবে। তাদের পাড়াছাড়া হতে হবে। এইসময় এই বয়সে তারা কোথায় যাবে। প্রজন্মান্তর যে জায়গায় তারা কাটিয়ে আসছে একটা ঠুনকো কারণে তার জন্যে তাদের ভিটেছাড়া হতে হবে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। অলোকা তা হতে দেবে না। এমনসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায় অলোকা। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তাকে নিয়ে সভায় হুটোপুটি পড়ে যায়। আঁজলা করে জল মুখে ছিটিয়ে দিলে ধীরে ধীরে সে স্বাভাবিক হয়। সনাতন তখন অখিলকে বলল,“অখিলদা তুই অসুস্থ অলোকাদিকে বাড়িতে রেখে আয়। এই অবস্থায় ওর স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হলে আমরা দায়ী হয়ে যাব।”
সনাতনের কথামত অখিল তার ছেলেদের নিয়ে অলোকাকে বাড়ি পৌঁছে দেবার তোড়জোড় শুরু করতেই বিচারকদের অন্যতম মাথা দিবাকর-নিত্যানন্দরা বলল, “মেয়েটা এখন সুস্থ হয়ে গেছে। মূল অভিযোগ যার বিরুদ্ধে সে না থাকলে বিচার কেমন করে হবে। ওকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। মনে হচ্ছে পরিকল্পনা করে ওকে এখান থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছে।”
এবার অখিল আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না। প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, “একজন নির্দোষ অসুস্থ মেয়ের প্রতি এমন ব্যবহার নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছু নয়। এই মেয়েটা কি অন্যায় করেছে? ও একজনকে ভালবেসেছে। তাকে বিয়ে করতে চায়। এতে তার দোষ কোথায়! অলোকা একজন শিক্ষিত স্বাধীনচেতা মেয়ে। তার উপর সে সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। তার জ্ঞানবুদ্ধি, ভাবনাচিন্তার কোন মূল্য নেই! আর ওই মুর্খ মাতালরা বলে কিনা তাদের পাড়ার কাউকে বিয়ে করতে হবে? একটা মেয়ের রোজগারের টাকায় খাবে, মাতলামো করবে আর বিলের মোষ তাড়াবে? সেই খোয়াব দেখা হবু স্বামীটা কে শুনি? জাত রক্ষার ধুয়ো তুলে একটা মেয়েকে অপদস্ত করার কোন অধিকার নেই এই নোংরা ছেলেদের। আর কে আছে সেই উপযুক্ত সুপুরুষ যাকে অলোকার উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছে? দেখি তো একবার তার বদন খানা। অভয়, তুই তো তিন সন্তানের বাপ। তুই অলোকার পয়সায় বসে বসে খাবি বলে আবার বিয়ে করার দুঃস্বপ্নে মশগুল হয়ে আছিস নাকি!”
অখিলের যুক্তির কাছে কথা খুঁজে না পেয়ে অভয় আমতা আমতা করে বলল,“আমি কেন বরেণ তো আছে। ও তো এখনো বিয়ে করেনি। স্বজাতির মধ্যে বরেণই অলোকার উপযুক্ত স্বামী হতে পারে বলে আমরা মনে করি।” অভয়ের কথায় তাল দিয়ে দিবাকর বলে, “একদম ঠিক কথা বলেছে অভয়। আমারও তাই মত।” সঙ্গে সঙ্গে অখিল বলে, “দশবার জন্মালেও বরেণ অলোকার উপযুক্ত হতে পারবে না। কি যোগ্যতা আছে ওর। ও স্বজাত। এটাই ওর যোগ্যতা? অলোকা অন্য জাতের ছেলেকে বিয়ে করলে ওর জাত চলে যাবে? কেন যাবে? যেখানেই ওর বিয়ে হোক, অলোকা, অলোকা রুইদাসই থাকবে। রুইদাসদের রক্ত ওর শরীরে বইছে। জন্মসূত্রেই ও রুইদাস ছিল, আছে, থাকবে। সে রক্ত কে টেনে বার করে অন্য জাতের রক্ত ঢোকাবে? অলোকা কেন পাল কুমোর হতে যাবে? হ্যাঁ, বিপ্লবকে বিয়ে করলে বিপ্লবের সন্তান, যে অলোকার পেটে ধারণ করবে তারা পাল হতে পারে। অলোকা নয়। আমাদের রুইদাস জাতের কোন ক্ষতি হবে না তাতে। আর দিবাকর কাকা, তুমি নিষ্কর্মা হয়ে বসে আছো। বাড়ির মেয়েরা উদয়-অস্ত খেটে পয়সা রোজগার করে তোমাকে খাওয়াচ্ছে। আর তুমি এইসব মাতালদের দলে ভিড়ে মাতাল হয়ে ওদের সাওটা গাইছো। ভেবেছ একবার, তোমার বাড়ির মেয়েদের থেকে আমি যদি কাজ তুলে নিই, তোমার কি হাল হবে? ওই পুকুরের পাঁক তুলে তাতে উপুড় হয়ে শুয়ে পেটের জ্বালা জুড়োতে হবে। তাও যতক্ষণ কে ততক্ষণ।”
অখিল এমন কথা বলার পর দিবাকরদের পক্ষে যারা আছে তারা হইচই ফেলে দেয়। নিত্যানন্দ বলে, “অখিল একজন বয়স্ক সদস্যকে এভাবে শাসাতে পারে না। অখিলও বেজাতের মেয়েকে বিয়ে করেছে বলে জাত-বেজাত গুলিয়ে দিতে চাইছে। ওকে আমরা ক্ষমা করে দিয়ে ভুল করেছি। ওর পুনরায় বিচার করে শাস্তি দেওয়া দরকার।”
এবার অখিলের পক্ষ নিয়ে সনাতনের বাবা রতনের বিশ্বস্ত সুভাষ বলে,“অখিল তার জাত খোয়ালো কোথায়! সে তো অন্য জাতের মেয়েকে রুইদাস করে নিয়েছে। অখিলের বউ রুইদাস সমাজকে নিজের হিসেবে মেনে নিয়েছে। অতএব তোমাদের এই যুক্তি ধোপে টেকে না। এই চল, আমরা অলোকাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। এই অসভ্যরা সবাই মিলে ওকে অপমানে অপমানে বিধ্বস্ত করে ফেলছে।” তখনই দিবাকর, নিত্যানন্দরা আবার চাপ দিয়ে বলে,“ওই শিক্ষিতদের কোন যুক্তি আমরা মানব না। এই কেসের বিচারে আগে যেমন রায় দেওয়া হয়েছে, আজও তেমন শাস্তি এই মেয়েটাকে তার পরিবারকে পেতে হবে।”
এই বাদানুবাদের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে পক্ষ-বিপক্ষর চিৎকার চেঁচামেচি ! বিষয়টা নিয়ে রুইদাস পাড়া আড়াআড়ি দুটো ভাগ হয়ে গেছে। এটা মোটেই ভাল লক্ষণ নয়। বলা যায় না, এটাকে বাড়তে দিলে রুইদাস পাড়ায় গৃহযুদ্ধও বেধে যেতে পারে। এবার সনাতন দেখল তার হস্তক্ষেপ ছাড়া এই গণ্ডোগোল মেটার উপায় নেই। এই সমস্যার সমাধান এখানে করা যাবে না। একটা জোর চিৎকার করে উঠল সনাতন! সনাতনের মত শান্তশিষ্ট ছেলে যে এতো জোর কথা বলতে পারে, সভা কল্পনাই করতে পারেনি। মুহূর্তের মধ্যে সভা একদম স্তব্ধ! এই সময়টাকে কাজে লাগাতে সনাতন বলল,“আটচালার একটা অতীত ভুলকে তুলে ধরে বর্তমানে দাঁড়িয়ে আর একটা ভুল করা কোন যুক্তিযুক্ত কাজ নয়। সময়ের সাথে সাথে আমাদের চিন্তাভাবনারও পরিবর্তন করা প্রয়োজন। নাহলে কোন জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। আমি বুঝতে পারছি, এই বিচারসভা কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারবে না। কোনভাবে কোন পক্ষের আর বেশি বাড়াবাড়ি করা চলবে না। আমি পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে এই বিষয়টা পঞ্চায়েতের বিচারসভায় ফেলতে চাই। সেখানকার সিদ্ধান্ত যদি মেনে নেওয়া না হয় তো দরকারে আমরা পঞ্চায়েত থেকে কেসটাকে থানায় পাঠিয়ে দেব। সেখানে দেশের আইন যা বলে সেটাকে সবাই মেনে নিতে বাধ্য।” তারপর সুবোধ কাকার উদ্দেশে বলল,“কাকা, আমি যা দেখতে পাচ্ছি আজকের সভায় এই সমস্যার কোন সমাধান হবে না। অসমাপ্ত এই সভা, পঞ্চায়েতের শালিশি সভায় ফেলার জন্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে আজ এই সভা মুলতুবি করে দেওয়া হোক। রুইদাসদের বাঁচাতে গেলে আর বিকল্প পথ আমাদের সামনে নেই।”
পঞ্চায়েত প্রধান, সনাতন রুইদাসের কথা মত পাড়ার সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ, সুবোধ কাকা এদিনের সভা সমাপ্তি ঘোষণা করে। এরপর আর কোন চেঁচামেচি, হইহুল্লোড় নেই। ফিসফিসে গুনগুনে এক সমবেত শব্দ আটচালা থেকে জন্ম নিয়ে রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে যেতে মিলিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু অভয়-বরেণদের গুলতানি আর যেন থামতে চায় না। পাড়ার আরও জনা- দুই মোদো মাতালকে জুটিয়ে তারা তেমাথানি মোড়ের বটগাছের গোড়ায় বসে চুল্লু খেতে খেতে কত যে শলা-পরামর্শ করতে থাকে কে জানে! সনাতনের নজর তা এড়ল না বটে। তবে ওইসব মাতালদের আর বেশি গুরুত্ব দিতে চাইল না। গুরুত্ব দিলেই ওরা পেয়ে বসবে।
বিপ্লব কোথায় আছে, তাদের পাল পাড়া বা রুইদাস পাড়ার কেউ জানে না। অলোকাও জানে না। অলোকাকে বলেনি বিপ্লব। মাঝে মাঝে বিপ্লব অলোকার স্কুলের ছুটি হয়ে গেলে মজলিশপুরের মোড়ে অপেক্ষা করে অলোকার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। অলোকা পায়রাচালী প্রাইমারী স্কুল থেকে এই পথেই এক কিলোমিটারের মত রাস্তা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরে। পাড়া অলোকাকে সম্মান জানাবে তা অলোকার কাছ থেকে বিপ্লব জেনেছে। তবে জানেনি যে ওইদিনও ওদের দু’জনকে জড়িয়ে আবার আলাদা একটা বিচারসভা রুইদাসদের আটচালায় বসবে। খুশি মনে বিপ্লব পরদিন অলোকার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, কেমন তার সংবর্ধনা সভা হল জানার জন্যে। সেদিন ও আশা নিয়ে এসেছিল, অলোকার খুশি মন দেখবে বলে। ভেবেছিল হয়তো অবোধ রুইদাসরা বোধে ফিরে তার কাজের সমর্থন করতে এই অনুষ্ঠান করছে। কিন্তু অলোকার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই খুশির লেশমাত্র দেখা গেল না। বিপ্লবও গম্ভীর হয়ে গেল কোন অশনিসংকেতের শঙ্কায়! সেদিন অলোকা মজলিশপুরের মোড় থেকে কথা বলে বাড়ি ফেরেনি। ওরা দু’জন মজলিশপুর থেকে পশ্চিমের ফাঁকা রাস্তা ধরে হরিণডাঙ্গামুখো হল। মাঝে জাগলার পোলের নিরিবিলিতে বহুক্ষণ বসে রইল। কথার মাঝে একবার বিপ্লব অলোকার কান্নাভেজা মুখ মুছিয়ে দেয় তো অলোকা বিপ্লবের। কতক্ষণ যে এমন আদানপ্রদান চললো ! পশ্চিমাকাশের সূর্য ডোবার যন্ত্রণাঋদ্ধ লালাভ আলো বিচ্ছুরিত হবার দৃশ্য নজরে আসতে বিপ্লব বলল, “এবার বাড়ি চলো অলোকা। শীতের সন্ধ্যা। ঠান্ডাও বাড়ছে। তোমাকে এগিয়ে দিই। আর এখানে থাকা আমাদের ঠিক হবে না। ‘দিননাথ’ পাটে যাবার পর জায়গাটা সাধারণের জন্যে নিরাপদ নয়। প্রকৃত মৃত্যুর আগে অপঘাত মরণে কোন কৃতিত্ব নেই।”
-প্রকৃত মরার আর বাকি রইল কোথায় বিপ্লবদা! এখন তো কেবল বেঁচে আছে আমার এই নশ্বর দেহটা। মান-সম্মান, ব্যক্তিত্ব কোন কিছুর অবশেষ আছে নাকি আমার আর? সেটা যখন নেই তখন সমাজের দুষ্ট মানুষের আক্রমণে যদি আমার মরণ হয় তো হোক না। পরক্ষণেই আবার নিজেকে শক্ত করে অলোকা বলল,“তাছাড়া তুমি তো আমার পাশে আছো বিপ্লবদা। এই যুগল শক্তিকে একত্র করে আমরা শত্রুকে প্রতিরোধ করতে পারব না? যেমনটা আমাদের অবোধ সমাজের বিরুদ্ধে করে চলেছি। না পারলে সহ-মরণ হয় হোক। ক্ষতি কি! আর একটু বসো। তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না আজ আমার। আরও দু’দন্ড বসি। তারপর যাচ্ছি।” একপ্রকার মরিয়া হয়ে যেন কথাগুলো বলল অলোকা ।
দেখতে দেখতে সাতটা বেজে গেল। এইসময় গ্রামের শীতের রাত মানে অনেকটাই রাত বলে মনে হয়। মনে মনে অলোকা ভাবল এতটা রাত না করলেই হত। বাড়িতেও চিন্তা করবে। এখান থেকে এতটা পথ হেঁটে যেতে হবে। রাত আটটার কাছাকাছি হয়ে যাবে বাড়ি পৌঁছতে। বিপ্লব বলল, “এখন আর তোমাকে মজলিশপুরের মোড়ে ছেড়ে দেব না। চলো বাড়ির কাছাকাছি উত্তমের লেদ কারখানার সামনে ছেড়ে দিয়ে আসি। ওখান থেকে তোমাদের আটচালার আলো দেখা যায়। ওটাকে লক্ষ্য করে চলে যেতে পারবে। যদি তোমাদের পাড়ার কেউ আমাকে দেখে ফেলে ফেলবে। কিচ্ছু করার নেই আমার। সেই ভয়ে আমি তো আমার ভালোবাসাকে হেলাফেলা করতে পারি না।”
হেড়ো পাগলা, পাগলের খেয়ালে কখন কোথায় থাকে তার হদিস ভালো মানুষের পাওয়া মুশকিল। রাতে কবে যে বাড়িতে শুয়েছে, তার মা নিজে সঠিক বলতে পারবে না। চরাচরই যেন ওর ঘরবাড়ি আত্মীয়স্বজন। ওর কাছে সবাই আপনজন। কতদিন হয়েছে আটচালার ফাঁকা মেঝেতে ঘুমিয়ে থেকে রাত কাবার করে দিয়েছে। বাধাহীন চেতনায় রাতের সঙ্গে সখ্যতা করার জন্যে আটচালাই তার প্রথম পছন্দের জায়গা। শীতের রাত। ঘড়ির কাঁটা আটটাকে ছুঁয়ে গেছে কিছুটা আগে। রুইদাস পাড়া ততক্ষণে প্রায় ঘুমিয়ে কাত। হেড়ো পাগলাও আটচলার মেঝেতে ঝ্যাঁতলা বিছিয়ে তেলচিটে পড়া কম্বল জড়িয়ে থরথর করে কেঁপে চলেছে। কখন ঘুম আসবে তবে সেই কাঁপুনি থামবে। হঠাৎ একজন মেয়েমানুষের মরণ চিৎকারে তার পৃথিবীটা যেন টলমল করে উঠল! গায়ে মোড়া কম্বলটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে সে দেখে গামছা দিয়ে মাথা-মুখ ঢাকা দুটো লোক ছুটে পালাতে পালাতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল! আর রাস্তায় ঠিকরে পড়া আটচালার আলোতে দেখতে পেল অদূরেই রক্তাক্ত অবস্থায় একটা মেয়ে গোঁ গোঁ করে কাতরাচ্ছে। সভয়ে হেড়ো পাগলা নীচু হয়ে দেখতে গেল কে মেয়েটা! মনে হল এ আর কেউ না তাদের পাড়ার অলোকা দিদিমণি। পাগলের মাথা প্রথমে ভিমরি খাবার মত হয়ে যায় ! কিন্তু যারা পেছন থেকে মেয়েটার মাথায় বাড়ি মেরে পালালো তারা কারা! অন্ধকারে বুঝতে পারল না। ততক্ষণে ওর বুকের ধড়ফড়ানি আরও বাড়তে লাগল। কিন্তু পাগলেরও মন বলছে, তাকে ভালো করে জানতে হবে রক্তাক্ত মেয়েটা কে? সময় নষ্ট করলে চলবে না। বিড়ি খাবার ম্যাচিসটা পকেট থেকে নিয়ে খস করে আলো জ্বালিয়ে হাত বাড়িয়ে মুখের কাছে ধরতে চিনতে পারে সেই মুখটা, ঠিকই তো! এ তো তাদের অলোকা দিদিমণি! নিশ্চিত হয়েই ম্যাচিস-ফ্যাচিস ছুড়ে ফেলে বিকট চিৎকার জুড়ে দিয়ে ছুটতে থাকে,“ও সনাতন দাদা, ও সনাতন দাদা। তোমরা সব ওঠো! জাগো! ওঠো গো সনাতন দাদা। ওঠো গো অখিল দাদা! আমাদের অলোকা দিদিমণিকে কারা খুন করে পালাল। পাড়াপড়শিরা সবাই ওঠো গো। সব সর্বনাশ হয়ে গেল। আমাদের অলোকা দিদিমণি খুন হয়ে গেল গো। ও সনাতন দাদা ওঠো !” বলে ছুটতে ছুটতে রাস্তায় উঁচু হয়ে থাকা একটা ইটে হোঁচট খায়! সঙ্গে সঙ্গে পায়ে পা জড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে হেড়ো পাগলা!
-সমাপ্ত-